বাচ্চাদের পাতলা পায়খানা হলে করণীয় ও ব্যবহৃত সিরাপের নাম

বাচ্চাদের পাতলা পায়খানা বা ডায়রিয়া একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা, যা প্রায়ই শিশুদের মধ্যে দেখা যায়। এটি সাধারণত খাবারের সংক্রমণ, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, বা খাদ্য অ্যালার্জির কারণে ঘটে থাকে। পাতলা পায়খানার ফলে শিশুর শরীর থেকে প্রচুর পানি বের হয়ে যায়, যা ডিহাইড্রেশনের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এই ব্লগে আমরা জানবো, বাচ্চাদের পাতলা পায়খানা হলে কী করণীয়, কীভাবে ঘরে বসে যত্ন নেওয়া যায় এবং কোন সিরাপ বা ওষুধ ব্যবহৃত হয়।


বাচ্চাদের পাতলা পায়খানার কারণসমূহ

ভাইরাল সংক্রমণ: রোটা ভাইরাস ও নরো ভাইরাসের মতো ভাইরাস শিশুদের মধ্যে পাতলা পায়খানা সৃষ্টি করতে পারে। এটি সাধারণত শিশুদের মধ্যে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ: স্যালমোনেলা, ই. কোলাই, শিগেলা ইত্যাদি ব্যাকটেরিয়া শিশুদের অন্ত্রে সংক্রমণ ঘটিয়ে ডায়রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।

প্যারাসাইট সংক্রমণ: জিআরডিয়া (Giardia) এবং ক্রিপ্টোস্পোরিডিয়াম (Cryptosporidium) জাতীয় প্যারাসাইট বাচ্চাদের ডায়রিয়ার অন্যতম কারণ হতে পারে।

খাদ্য অ্যালার্জি: কিছু বাচ্চার দুধ বা অন্যান্য খাবারে অ্যালার্জি থাকে, যা তাদের হজম প্রক্রিয়ায় সমস্যা সৃষ্টি করে এবং পাতলা পায়খানা হতে পারে।

অতিরিক্ত ফলের রস: অতিরিক্ত আপেল, আঙ্গুর বা অন্যান্য ফলের রস পান করলে শিশুরা হজমে সমস্যা অনুভব করতে পারে, যা পাতলা পায়খানার দিকে নিয়ে যায়।

অ্যান্টিবায়োটিকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: কিছু অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করলে শিশুদের অন্ত্রে ভালো ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, ফলে ডায়রিয়া হতে পারে।

বাচ্চাদের পাতলা পায়খানা হলে করণীয়

পর্যাপ্ত পানীয় প্রদান করুন: ডায়রিয়ার সময় শিশুর শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি বের হয়ে যায়, ফলে শিশুর ডিহাইড্রেশন হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই শিশুকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি, ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন (ORS) বা ঘরে তৈরি লবণ-চিনি মিশ্রিত পানি খাওয়াতে হবে। 

সহজপাচ্য খাদ্য দিন: পাতলা পায়খানা হলে শিশুকে সহজপাচ্য এবং পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। যেমন খিচুড়ি, সেদ্ধ আলু, টোস্ট, কলা ইত্যাদি। 

বিশ্রাম নিশ্চিত করুন: শিশুর শরীরের দুর্বলতা কাটানোর জন্য তাকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দিতে হবে। অতিরিক্ত খেলা বা দৌড়ঝাঁপ থেকে বিরত রাখা উচিত।

পর্যবেক্ষণ করুন: বাচ্চার পায়খানার পরিমাণ, রঙ, এবং ধরণ লক্ষ্য করুন। যদি রক্তমিশ্রিত পায়খানা হয়, দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

বাচ্চাদের পাতলা পায়খানার জন্য ব্যবহৃত সিরাপ

বাচ্চাদের পাতলা পায়খানার চিকিৎসার জন্য কিছু ওষুধ এবং সিরাপ ব্যবহৃত হয়, তবে সেগুলো শুধুমাত্র ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবহার করা উচিত। নিচে কিছু সাধারণ সিরাপের নাম ও তাদের ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

জিঙ্ক সিরাপ (Zinc Sulfate):

কার্যকারিতা: জিঙ্ক ডায়রিয়ার সময় অন্ত্রের সংক্রমণ কমাতে সহায়ক এবং শিশুর ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে। এটি ডায়রিয়া থেকে দ্রুত পুনরুদ্ধারে সহায়ক।
ডোজ: সাধারণত ডায়রিয়া হলে ১০-১৪ দিন জিঙ্ক সিরাপ ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়। ডাক্তারের নির্দেশিত ডোজ অনুযায়ী এটি খাওয়ানো উচিত।

ওআরএস (ORS - Oral Rehydration Solution):

কার্যকারিতা: ORS ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর। এটি শরীরের ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্য বজায় রাখে এবং শরীরের পানি শূন্যতা পূরণ করে।
ডোজ: শিশুর ওজন অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ ORS দিনে কয়েকবার অল্প অল্প করে খাওয়ানো উচিত।

প্রোবায়োটিক সিরাপ:

কার্যকারিতা: প্রোবায়োটিক সিরাপ অন্ত্রে ভালো ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি করে, যা হজম প্রক্রিয়াকে স্বাভাবিক করতে সহায়ক। এটি ডায়রিয়ার প্রভাব কমাতে সহায়ক।
ডোজ: সাধারণত দিনে ১-২ বার ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী প্রোবায়োটিক সিরাপ খাওয়ানো হয়।

রেসেকাডোট্রিল (Racecadotril):

কার্যকারিতা: এটি একটি অ্যান্টিসেক্রেটরি ওষুধ, যা অন্ত্রের অতিরিক্ত পানি ও ইলেক্ট্রোলাইট নিঃসরণ কমিয়ে দেয় এবং ডায়রিয়ার লক্ষণগুলি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
ডোজ: এটি শুধুমাত্র ডাক্তারের পরামর্শে ব্যবহার করা উচিত, এবং সঠিক ডোজ অনুসরণ করতে হবে।

ডাক্তারের পরামর্শ কখন প্রয়োজন?

গুরুতর ডিহাইড্রেশন: বাচ্চার ঠোঁট শুষ্ক হয়ে গেলে, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে গেলে, অথবা শিশুর চোখ গর্তের মতো দেখালে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

রক্তমিশ্রিত পায়খানা: যদি শিশুর পায়খানায় রক্ত দেখা যায়, তাহলে এটি গুরুতর সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। এই ক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা নিতে হবে।

বমি বা উচ্চ জ্বর: যদি শিশুর সঙ্গে সঙ্গে বমি হয় বা উচ্চ জ্বর থাকে, তাহলে এটি সাধারণ ডায়রিয়া নয়। ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

পাতলা পায়খানা না কমলে: যদি ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে শিশুর ডায়রিয়া কমার লক্ষণ না থাকে, তবে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

বাচ্চাদের পাতলা পায়খানা হলে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সঠিক যত্ন এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। বাচ্চাকে পর্যাপ্ত পানি পান করানো, পুষ্টিকর খাদ্য দেওয়া এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ ও সিরাপ ব্যবহার করার মাধ্যমে বাচ্চার সুস্থতা নিশ্চিত করা সম্ভব। তবে সব সময় ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ বা সিরাপ ব্যবহার করা উচিত, কারণ বাচ্চাদের শরীর সংবেদনশীল এবং সঠিক চিকিৎসা না হলে তা ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
Previous chapter Next chapter
No Comment
Add Comment
comment url